কিয়ামতের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বৃক্ষরোপণে উৎসাহ | বৃক্ষরোপণে ইসলামের উৎসাহ ও নির্দেশনা

Estimated read time 1 min read

একসময়ের ছয় ঋতুর রূপময় বাংলাদেশ ক্রমেই তিন-চার ঋতুতে দৃশ্যমান হচ্ছে। পরিবেশের বিপর্যয় এর অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র দাবদাহ পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে সজীব পরিবেশ অপরিহার্য অনুষঙ্গ।আর সতেজ ও নির্মল পরিবেশ তৈরিতে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

পরিবেশ গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের আয়তন অনুযায়ী বৃক্ষের প্রয়োজন শতকরা ২৫ ভাগ। অথচ বর্তমানে মাত্র ১৭ শতাংশ রয়েছে এই বৃক্ষ ও বনভূমি। তাই দেশের পরিবেশের ভারসাম্য ও সতেজতা ধরে রাখতে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই।

ইসলাম কিয়ামতের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যায় উৎসাহিত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে। ’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯)

বৃক্ষ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সব ধরনের উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। ’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ৭-৯)

বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় শুধু পরিবেশই রক্ষা হয় না, বরং এই কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে অনেক সওয়াবও অর্জন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণের ফজিলত উল্লেখ করে সাহাবাদের উৎসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান) স্বরূপ গণ্য হবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ২৩২০)

অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৫৬৭)

সুবহানাল্লাহ! এভাবে বহু হাদিসে নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতদের বৃক্ষরোপণে উৎসাহী করেছেন। অন্য দিকে অহেতুক বৃক্ষরোপণ রোধে নবীজি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বরইগাছ কাটবে আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। ’

ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-কে এ হাদিসের অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এ হাদিসের বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত্ত, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে ব্যক্তি অকারণে বা অন্যায়ভাবে মরুভূমির কোনো বরইগাছ কাটবে, যেখানে পথিক বা কোনো প্রাণী ছায়া গ্রহণ করে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৩৯)

এমনকি নবীজি (সা.)সহ পরবর্তী সব খলিফা সৈন্যদের প্রতিপক্ষের কোনো গাছপালা বা শস্যক্ষেত্র ধ্বংস না করতে নির্দেশ দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘তোমরা কোনো বৃক্ষ উৎপাটন করবে না। ’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৯৪৩০)

কারণ গাছ মহান আল্লাহর অমূল্য নিয়ামত। এটি ধ্বংস করলে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আড়াই শ বছরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদ। শুধু উদ্ভিদ নয়, এর সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক পাখি, স্তন্যপায়ী এবং উভচর প্রাণীও।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাভাবিক প্রত্যাশার চেয়ে ৫০০ গুণ দ্রুত ঘটেছে এসব উদ্ভিদের বিলুপ্তি, যা পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত খারাপ খবর। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. রব সালগেরো বলেন, ‘খাবার, আশ্রয়, নির্মাণসামগ্রী—এর সবই আমরা পাই উদ্ভিদের কাছ থেকে। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, কার্বন নিঃসরণ, অক্সিজেন সৃষ্টি এমনকি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও নির্ভর করতে হয় উদ্ভিদের ওপর।

তাই আসুুন, সবাই মিলে সুস্থ, সুন্দর ও সবুজাভ পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণে উদ্যোগী হই। এতে করে আমরা রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে সওয়াব অর্জনের পাশাপাশি দেশের পরিবেশ রক্ষায়‌ও ভূমিকা রাখতে পারব। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা জরুরি। আর ভারসাম্যপূর্ণ ও দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বৃক্ষের।বৃক্ষ শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়; বরং ধর্মীয় কারণেও মানুষের বৃক্ষরোপণ করা চাই। মহানবী (সা.) পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও তা পরিচর্যার কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন হাদিসে উৎসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছেন।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ শতাংশই বৃক্ষ। বৃক্ষ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশের কল্পনা করা অবান্তর।

ইসলাম সঙ্গত কারণেই পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে উদসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছে।

বৃক্ষরাজি ও প্রকৃতি নিয়ে কোরআনের বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল সৃষ্টি করেছেন। বনভূমির মাধ্যমে পৃথিবীকে সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। গাছপালার মাধ্যমে ভূমণ্ডল ও পরিবেশ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য সংরক্ষণের শিক্ষা দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে তাই ঘোষণা এসেছে—‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। ’ (সুরা কাফ, আয়াত: ৭-৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান, তখন তারা আনন্দিত হয়। (সুরা রুম, আয়াত: ৪৮)
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির কিছু দৃশ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। যেন মানুষ প্রাকৃতিক বিচিত্র, প্রকারভেদ, বর্ণ, গন্ধ ও সৌন্দর্য দেখে পুলকিত ও অভিভূত হয়। সব কিছুর উন্নতি, অগ্রগতি ও সক্রিয়তা দেখে মানুষ আল্লাহর শক্তিমত্তার কথা স্মরণ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে জন্মান শস্য, জাইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও সব ধরনের ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন। ’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১১)

বৃক্ষরাজি যে কত বড় নিয়ামত, পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে তা প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি ঊষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে। ’ (সুরা সাজদা, আয়াত: ২৭)

একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য কত?

গাছবিহীন এক মুহূর্তও অসম্ভব। মানুষের যাপিত জীবনের সব কিছুই গাছকে ঘিরে ও গাছকে নিয়ে। তাই গাছ নিধন হলে গাছ শুধু একাই মরে না। মানুষসহ সব প্রাণসত্তার জন্যই তা ঝুঁকি ও উত্কণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়।

ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদান আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান যে ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার (সূত্র : ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিয়ম-১১, সংখ্যা-১-২)

বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে হাদিসে উৎসাহ ও নির্দেশনা

হাদিসে এসেছে, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান) স্বরূপ গণ্য হবে। ’ (বুখারি, হাদিস: ২৩২০, মুসলিম, হাদিস: ১৫৬৩/১২)

এ হাদিসটি আরও স্পষ্ট করে অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে সদকার নেকি দেবেন। ’ (মুসনাদ আহমাদ: ১৬৭০২)
অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৫৬৭)

বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা সম্পর্কে হাদিস

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে নির্দেশ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে। ’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৪৭৯; মুসনাদ আহমদ, হাদিস: ৩/১৮৩)

অন্য বর্ণনায় মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামত এসে গেছে, এমন অবস্থায় তোমাদের কারো হাতে যদি ছোট একটি খেজুরগাছ থাকে, তাহলে সে যেন গাছটি রোপণ করে দেয়। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১২৯০২; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৪৭৯; মুসনাদে বাজজার, হাদিস: ৭৪০৮)

বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটার শাস্তি
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে [যে গাছ মানুষের উপকার করতো], আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন। ’ (বায়হাকি, হাদিস: ৬/১৪০)
অবশ্য এই হাদিসের বর্ণনা দুর্বল। হাদিসবিশারদরা দীর্ঘ ব্যাখ্যা ও প্রাসঙ্গিকতা বর্ণনা করেছেন।

বৃক্ষের ছায়ায় মহানবী (সা.)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘মক্কা এবং মদীনার মাঝে অবস্থিত একটি বৃক্ষের নিকট যখন তিনি আসতেন তখন তার নীচে শুয়ে বিশ্রাম করতেন। তিনি বলতেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এরূপ করতেন। (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস: ৪৭)
গাছ-বৃক্ষ প্রকৃতি ও পরিবেশের ‘বন্ধু’। তাই নির্বিচারে গাছ না কেটে প্রচুর বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours