মৃত্যু চিরন্তন অবিচল সত্য
যে জন্মেছে সে মরবেই। যার সূচনা হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটবেই। এটা খোদা পাকের শাশ্বত চিরন্তন বিধান। এ অমোঘ বিধানের কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন নেই।পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে চির ও অনড় সত্য হলো মৃত্যু।
প্রত্যেক প্রাণীকে মরতে হবে। ছারপোঁকা থেকে শুরু করে প্রাণওয়ালা যত সৃষ্টিজীব আছে সবাইকে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। ইন্তেকালের কবল থেকে জগতের কোন তাবৎ পরাশক্তি কোন প্রযুক্তি কাউকে বাঁচাতে পারবে না।
এখানে সবাই অক্ষম। মৃত্যুর নির্ধারিত সময় থেকে এক সেকেন্ড কমবেশি করার ক্ষমতা রাখেনা জগতের কোন দাপটশালী মোড়ল। মৃত্যুর অনীবার্য স্বাদ হর প্রাণীকে পান করতে হবে। আল্লাহ বলেন, “প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। ” সূরা আনয়াম ১৮৫।
এই আয়াতের তাফসীরে ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, প্রত্যেক প্রাণওয়ালা প্রাণীই মরণশীল। বেলা শেষে সূর্য যেমন সব পাঠ চকিয়ে বিদায়ী হয়। তাকে বিদায় নিতে হয় । দিবাকরের অস্ত পথ যেমন কেউ রুখতে পারে না। ঠিক তদ্রুপ মানুষের মৃত্যুর সময় যখন আসন্ন হবে, মৃত্যুর ঘণ্টা ধ্বনি যবে বেজে উঠবে তখন কেউ মৃত্যুকে প্রতিহত করতে পারবে না। নির্ধারিত সময় থেকে পূর্বপরে মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম হবে না।
আল্লাহ বলেন, “যখন তাদের (মৃত্যুর) সময় হয় তখন তারা মুহূর্তকাল অগ্রবর্তী ও পশ্চাতবর্তী হতে পারে না”। সূরা নাহল ৬১।
কখন কোন মানুষের বা প্রাণীর তিরোধান হবে এটা কেউ জানেনা। দুনিয়াতে আগমনের পরিক্রমা সিরিয়াল আছে, প্রথমে দাদা পরে পিতা তারপর নাতি। কিন্তু যাবার কোন সিরিয়াল নেই। যখন যার ডাক আসে তাকে তখনি পরপারে চলে যেতে হবে। সামন্য সময়ের ফুরসৎ দেয়া হবে না। কুরআনে পঠিত হয়েছে, “যখন কারো কর্ম-সময় পূর্ণ হয়ে যাওয়ার মুহূর্ত এসে পড়ে, তখন আল্লাহ তাকে কখনই অধিক অবকাশ দেন না। ” সূরা মুনাফিকুন ১১।
মৃত্যু কাউকে জানান দিয়ে আসে না। কোন সময় বা স্থান কাল নির্ধারিত জায়গা ধরে উপস্থিত হয় না। মানুষ জানে না কার মৃত্যু কোথায় কোন জমিনে হবে। আল্লাহ বলেন, “কোন প্রাণীই জানেনা আগামিকাল সে কী উপার্জন করবে। এবং কেউ জানেনা তার মৃত্যু হবে কোন জমিনে। ” সূরা লোকমান ৩৪।
দুনিয়ার জগত হলো ক্ষণস্থায়ী। একদিন জগত নির্মূল নাশ হয়ে যাবে। পৃথিবী তার অস্তিত্ব হারাবে। পৃথিবীতে কোন মানুষের চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে না। এই ধ্বংসশীল দুনিয়াতে মানুষও ধ্বংসশীল। আদম জাতিও ক্ষণস্থায়ী। একজন মুসাফির ভবঘুরে যেমন আপন ঠিকানাবিহীন পথ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়, তার চলতে পথে কোন নির্ধারিত বাসস্থান থাকে না, তেমনি দুনিয়াতে মানবজাতির পরোক্ষ কোন বাসস্থান নেই। যা আছে তা ক্ষণস্থায়ী। দুনিয়ার ময়দানে মানব হল মুসাফির। পৃথিবীর পথে সে হল বাউণ্ডুলে পথিক। তার হায়াতের নির্ধারিত সময়ের ভেতর পূঁজি সংগ্রহ করে পথ চলতে হবে। মুসাফির হয়ে পথের পাথেয় যোগাড় করতে হবে। ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত, ‘“তিনি বলেন রাসুল সাঃ আমার বাহুমূলে ধরলেন। তারপর বললেন, “দুনিয়াতে এভাবে কাটাও যেন তুমি মুসাফির বা পথিক”। হযরত ইবনে উমর বলেন, যখন সন্ধ্যা হয়ে যায় সকাল বেলার অপেক্ষা করো না। আর যখন সকাল হয়ে যায় সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। সুস্বাস্থের দিনগুলোতে রোগব্যাধির প্রস্তুতি নাও। আর জীবদ্ধশায় থাকাকালীন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করো। ” বোখারি ৬৪১৬।
এ কথা যখন দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট, কোরআন হাদিস তার প্রমাণ বহন করে যে, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সবাইকে মৃত্যুর উন্মুক্ত দরজায় প্রবেশ করতে হবে। তা আমাদের মম চিত্তকে পরিশুদ্ধ করা প্রয়োজন। কবরে সুখে থাকার উপকরণ সংগ্রহ করা লাযেম। মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা দরকার । প্রত্যেকটা কাজের প্রারম্ভে করোটিতে মৃত্যু নামক বাস্তব শব্দের চিত্র আঁকা অতিজরুরি। হাদিসে বিধৃত হয়েছে, আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সাঃ বলেছেন- (দুনিয়ার) স্বাদ গন্ধকে বিলুপ্তকারী মৃত্যুকে তোমরা বেশি বেশি স্মরণ করো। তিরমীযি ২৩০৭।
নশ্বর পৃথিবীর শাশ্বত চিরন্তন সত্য হলো মৃত্যু। মৃত্যুর চেয়ে অপরিবর্তনীয় অনড় শব্দ জগতের অভিধানে খুব কম। আখেরে সবাইকে জগত ছেড়ে পরপারে যেতে হবে এটা স্বাভাবিক। সুতরাং ধরার সব পাঠ শেষ করে ইসলামী জীবন ধারণ করে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণা বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক: রায়হান রাশেদ
মৃত্যু মানে কী?
মৃত্যু চিরন্তন অবিচল সত্য। মৃত্যুর চেয়ে কঠিন সত্য পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। যে জন্মেছে, সে মরবেই। মৃত্যু থেকে পালানোর পথ নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মরণশীল।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১৮৫; সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩৫; সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৫৭)
উল্কার রেডিওমেট্রিক বয়স নির্ণয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রায় ৪৫৪ ± কোটি বছর বয়সের এই পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকতে পারেনি। শুধু মানুষ নয়; কোনো প্রাণীও অমরত্ব লাভ করেনি। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তোমার আগেও আমি কোনও মানুষকে অমরত্ব দান করিনি। তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩৪)
মৃত্যু কী? মৃত্যু মানে কী শেষ হয়ে যাওয়া; নাকি নতুন কোনো কিছুর শুরু হওয়া? মরে যাওয়া মানে কি হারিয়ে যাওয়া নাকি বেঁচে যাওয়া? মৃত্যু হলো ইহলৌকিক জীবনের ইতি টেনে পারলৌকিক জীবনে প্রবেশ। চিরস্থায়ী জীবনের দিকে যাত্রা। মৃত্যু হওয়া মানে হারিয়ে যাওয়া কিংবা শেষ হয়ে যাওয়া নয়; বেঁচে যাওয়া কিংবা চিরস্থায়ী জীবনের সূচনা ঘটা।
জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো— পুনরুত্থিত হওয়া এবং ওপারের জীবনে সফলতা লাভ করা। পুনরুত্থিত হওয়ার ব্যাপারটা চিরসত্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তোমাদের পুনরুত্থিত করবেন তিনিই।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৬৬)
দারুল আমল বা কর্মক্ষেত্র হলো পৃথিবী। আর আখিরাত হলো দারুল জাজা বা প্রতিদান জগৎ। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ ‘দারুল আমল’ থেকে ‘দারুল জাজা’য় প্রবেশ করে। কর্মের জগতে রয়েছে কর্ম; রয়েছে অকর্মের অবকাশ। কর্মজগতের কর্ম আর অকর্মের ভিত্তিতে সজ্জিত হবে প্রতিদান জগৎ।
সেখানে থাকবে শুধু প্রতিদান। থাকবে না কোনো কর্ম বা অকর্মের কোনো অবকাশ। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর তোমাদের কর্মফল তো পূর্ণমাত্রায় বুঝিয়ে দেওয়া হবে কিয়ামতের দিন। এরপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে— সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন তো ছলনাময় ভোগ ছাড়া কিছুই নয়। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৫)
মানবজীবনটাই হলো পরীক্ষাকেন্দ্র। সীমিত প্রশ্ন। নির্দিষ্ট উত্তর। পরীক্ষা শেষে অপেক্ষমাণ চূড়ান্ত সফলতার হাতছানি অথবা শাস্তি। আল্লাহ বলেন, ‘পুণ্যময় তিনি, যার (কুদরতের) হাতে রাজত্ব। তিনি সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন; কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, মহাক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক, আয়াত : ২)
পরীক্ষার হলের সময়কুটু যথার্থ মূল্যায়ন করে সঠিক উত্তর প্রদানের মাধ্যমে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করা বুদ্ধিমানের কাজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সে; নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য উপার্জন করে যে। আর অক্ষম সে; নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে এবং আল্লাহর প্রতি অলীক প্রত্যাশা পোষণ করে যে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৪৫৯)
ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! সবচাইতে বুদ্ধিমান লোক কে? তিনি (সা.) বললেন, যে অধিকহারে মৃত্যুকে স্মরণ করে এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত থাকে।’ (ইবনে মাজাহ) দুনিয়াতে মুমিন সব সময় থাকতে পারবে না। নির্দিষ্ট সময় শেষে চলে যেতে হবে। তাই বেঁচে থাকার সময়ে চিরস্থায়ী জীবনে সুখে থাকার জন্য আল্লাহর আদেশ ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ মেনে চলতে হবে।
+ There are no comments
Add yours